কী অসাধারণ বাণী বুদ্ধের, ভাবলে অবাক হই। বুদ্ধ বলেন, মানুষ মৈত্রীপরায়ণ
হবে; মানুষ ক্ষমাশীল হবে এবং আরো হবে লোভ ও মোহহীন। মানুষ মানুষকে শ্রদ্ধা
করবে, একে অন্যকে সম্মান করবে এবং নানা গুণের প্রশংসা করবে। এটাই তো হওয়া
উচিত। কিন্তু আমরা কী দেখি? আমরা দেখি এর বিপরীতটা। আজ বাংলাদেশসহ সারা
বিশ্বের অবস্থা এত ভয়াবহ কেন? এত নাজুক কেন? কেন চলছে হিংসা-প্রতিহিংসার
তীব্র প্রতিযোগিতা? কেন চলছে ক্ষমতা লাভ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের তীব্র
আগ্রাসন? মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ কি এগুলোই? আমাদের দায়িত্ব কি জনগণের
অধিকার ও স্বাধীনতা হনন করা? নাকি জনগণের শান্তি ও অধিকার সংরক্ষণ করা?
কারোর মধ্যে তো সেই প্রবণতা দেখি না; দেখি না কোনো শুভবুদ্ধিও। এগুলো সভ্য
দেশ ও সভ্য মানুষের আচরণ হতে পারে না। মানুষ হয়ে মানুষের জীবন হনন করা যে
কত জঘন্য অপরাধ, সেটা আজ কাকে বোঝাই। একটি মানুষ আরেকটি মানুষকে দেখে-শুনে
কীভাবে হত্যা করতে পারে ভাবতে খুবই কষ্ট হয়। মন কি একটুও কাঁদে না? ঘৃণ্য
এসব আচরণ দিয়েই তো মানব ইতিহাসকে আমরা কলঙ্কিত করছি প্রতিনিয়ত। এজন্য তো আজ
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জীবনধারণের প্রতিকূল অবস্থা তৈরি হচ্ছে আমাদের জন্য।
নানা দুর্যোগ ও নানা বিপর্যয় নেমে আসছে আমাদের ওপর। প্রকৃতিও বিরূপ হয়ে
যাচ্ছে আমাদের নানা অনাচার অত্যাচারে।
তাই তো বৌদ্ধ ধর্মের উদার নীতিগুলো সম্পূর্ণ মানবতাবাদী ও সর্বজনীন
অধিকারমূলক বলে স্বীকৃত। এখানে চিত্ত সংকীর্ণতা, জাতি-ধর্ম-বৈষম্য কিংবা
কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা অথবা খণ্ডিত মানবতার প্রশ্রয় নেই। আছে শুধু
বিশ্বমানবতা বোধ, মহামৈত্রী, সম্প্রীতি আর বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্বের গভীর
মেলবন্ধন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ অপেক্ষা মানুষের মানবিক গুণাবলিই এখানেই বড় এবং
মনুষ্যত্বই শ্রেয়। তাই তো সব অবস্থায় ব্যক্তিকে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা,
উপেক্ষা— এ চার ব্রহ্মবিহারের ওপর সতত নিবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। এখানে
শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার ব্যবহার এবং অনুশীলন অপরিহার্য হিসেবে বিবেচ্য।
বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি হলো— অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। শুধু বৌদ্ধ ধর্মে নয়, অন্যান্য ধর্মেও এ নীতির কথা বলা হয়েছে। তবে ভিন্নতা শুধু এখানে, বৌদ্ধ ধর্মে নিজের প্রাণের মতো সব প্রাণীকে দেখা হয়েছে, সব প্রাণীর জীবন রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে, আর অন্যান্য ধর্ম মানবজীবনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। পার্থক্য শুধু এখানেই; নীতি, জীবনদর্শন ও আদর্শিক দিক থেকে তেমন পার্থক্য নেই।
বৌদ্ধ ধর্মমতে, পঞ্চশীলের পাঁচটি নীতি যথার্থভাবে পালন করাই হচ্ছে প্রকৃত বৌদ্ধ নীতি তথা মানবনীতি। এসব নীতি কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়; সব মানবজাতির জন্যই প্রযোজ্য। মানবজীবনের সামগ্রিকতায় সুনীতিপরায়ণ হওয়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম শিক্ষা আর কী হতে পারে! এজন্যই এসব নীতিই বৌদ্ধ ধর্মের প্রাণ ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বৌদ্ধ ইতিহাস ও জীবনদর্শনে বলতে গেলে এসব নীতিই মূলভিত্তি এবং মহামতি গৌতম বুদ্ধের উজ্জ্বল বাণী।
আজ গোটা বিশ্বে অহিংসা নীতিবাদের কথা বলা হচ্ছে। এমনকি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও। আজ বিশ্বের সব জায়গায় যেন একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং হিংসা ও সংঘাতের রাজনীতি চলছে। এছাড়া চলছে সমাজ, দেশ তথা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে মানবতা লঙ্ঘন ও দুর্নীতির দৌরাত্ম্য। তাই আজ মানুষ প্রতি মুহূর্তে পরস্পর পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করছে। অন্যের জীবন হনন করছে। অন্যের ক্ষতি করার জন্য সদা ব্যস্ত রয়েছে। এজন্যই সমাজ ও বিশ্বের চেহারা আজ এত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। এ নিয়ে আমরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারি, দেশ ও বিশ্বে অহরহ কী ঘটছে? ভিন দেশের কথা বাদই দিলাম। দেশে বর্তমানে গুম, হত্যা, নির্যাতন যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। কোনো প্রতিকার নেই। আইন ও বিচার যেন নীরবে কাঁদছে আদালতে। মানুষ বিচারের জন্য আর কোথায় যাবে? কে শোনাবে তাকে শান্তির বাণী?
কোথাও কোনো সহানুভূতি নেই। নেই কোনো সহনশীলতা ও সহমর্মিতা। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ব বোধ তো নেই বললেই চলে। অথচ আমরা আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষা-দীক্ষায় কত উন্নত হয়েছি; কত সভ্য হয়েছি। তার পরও বলব, আমরা প্রাচীন গুহাবাসী ও অরণ্যের হিংস্র প্রাণীর চেয়েও খারাপ। আমাদের কোনো আদর্শ নেই। নেই কোনো সৎ নৈতিকতা। নেই কোনো বিবেকবোধ। জ্ঞানশূন্য হয়ে কাজ করছি অন্ধের মতো, যা সম্পূর্ণ মানবতাবিরোধী। আমাদের চেয়ে বনের হিংস্র পশু-পাখি অনেক ভালো মনে হয়। তারাও শিকারের আগে চিন্তা করে ভালো-মন্দ। প্রতিদিনের করুণ ঘটনাগুলো দেখলে আমাদের হূদয় দারুণভাবে ব্যথিত হয়, অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
আমরা জানি মৈত্রী গুণ অনন্ত, অহিংসার গুণ অনন্ত। প্রেম ও সাম্যের গুণও অনন্ত। এ অনন্ত গুণ দিয়ে আমরা শুধু আমাদের ভূখণ্ড নয়, বিশ্বের সব ভূখণ্ডের মানুষকে একটি বাসোপযোগী শান্তি নীড়ে নিয়ে আসতে পারি। শুধু প্রয়োজন বিবেকবোধ, সিচন্তা, সত্কর্ম প্রভৃতি। আজ আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এর অভাব শুধু আমাদের দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও। তাই তো বলি, বিশ্বমৈত্রী ও বিশ্বসৌভ্রাতৃত্ববোধ গঠন করার জন্য মহামতি গৌতম বুদ্ধের অহিংসা ও সাম্য বাণীর তুলনা হয় না। সেজন্য বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। শুধু প্রয়োজন আন্তরিক সদিচ্ছা আর প্রীতিবোধের উদ্বোধন। আজ যদি সমাজ, দেশ তথা রাষ্ট্রের সব বিবেকবান মানুষ প্রীতিবোধে জাগ্রত হয়, হিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং মানবতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, তাহলে বিশ্বের চেহারা তো এ রকম থাকার কথা নয়। অবাধে হিংসা, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের রাজত্ব চলতে পারত না। আমরা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এর লালন করছি বলেই তো আজকের সমাজ ও বিশ্বে এত হিংসা, এত হানাহানি, এত সংঘাত।
No comments:
Post a Comment